Home প্রবন্ধ, সাহিত্য ও সংস্কৃতি বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস – প্রথম ভাগ – দ্বিতীয় পর্ব
প্রবন্ধসাহিত্য ও সংস্কৃতি

বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস – প্রথম ভাগ – দ্বিতীয় পর্ব

শৈবাল কুমার বোস

পঞ্চদশ শতাব্দীর সাহিত্য

১৩৪২ সালে সামসুদ্দিন ইলিয়াস শাহ বাংলার সুলতান হন। ইলিয়াস শাহ আপন ব্যাক্তিত্ব ও প্রতিভার প্রভাবে বৃহত্তর বঙ্গের আশা ও স্বপ্নের সাথে নিজেকে বহুলাংশে একাত্ম করে তুলেছিলেন। তাঁর উত্তরাধিকারীরাও সেই ঐতিহ্য অক্ষুণ্ণ রেখেছিলেন। পরবর্তী কালে আলাউদ্দিন হুসেন শাহের আমলেও এই ধারা অক্ষুণ্ণ ছিল। এই সময় গৌড় তীরহুত যোগ উল্লেখযোগ্য। তুর্কী সুলতানদের রাজ্যাবসানের আগে তীরহুতে গৌড় সুলতানের অধিকার ব্যাপ্ত হয়। তখন থেকেই একই সংস্কৃতির দুই বোধের পুনঃর্মিলন হয়। এর ফলে গৌড় দুভাবে লাভবান হলো, পান্ডিত্য চর্চায় স্মৃতি ও নব্যন্যায় এবং সাহিত্যচর্চায় ব্রজবুলী পদাবলী ও গানে।

গৌড়ের হিন্দু রাজকর্মচারী মন্ত্রীরা অনেকেই বিষ্ণুর উপাসক ছিলেন। তাদের কাছে নতুন করে বৈষ্ণবতার ঢেউ আসল তীরহুত থেকে। তীরহুতের উমাপতি-বিদ্যাপতির কৃষ্ণলীলা পদাবলী বাংলার লুপ্ত সাহিত্যবৃত্তিকে নতুন চেতনায় জাগিয়ে দিল। গৌড় সুলতান কর্তৃক সংবর্দ্ধিত মালাধর বসু ভাগবত পুরাণ অনুবাদ করেন ১৪৭৩ সালে ও গৌড়ের রামকেলি গ্রামে সুলতান হুসেন শাহর মহামন্ত্রী সনাতন পঞ্চদশ শতাব্দীর শেষে ভাগবত আলোচনা করেন। করঞ্জয় গ্রামীণ ব্রাহ্মণ চতুর্ভূজ বিধু মিনু শকাব্দে অর্থাৎ ১৪৯৬ অব্দে হরিহরিত কাব্য রচনা করেছিলেন। রামকেলিতে সনাতন ও রূপ নামে দুই ভাই বাস করতেন। এঁরা দুজনেই তৎকালীন সুলতান হুসেন শাহর প্রিয়পাত্র ছিলেন ও তার দারবারে উচ্চপদস্থ কর্মচারী ছিলেন। পদবলে এঁদের নাম ছিল সাকর মল্লিক (ছোটো রাজা) ও দবিরখাশ (প্রাইভেট সেক্রেটারি)। এই সময়েই রূপ কৃষ্ণলীলা বিষয়ে কয়েকটি সংস্কৃত কাব্য ও গীতিকা রচনা করেছিলেন। তার মধ্যে হংসদূত, উদ্ধবসন্দেশ ও গীতাবলী উল্লেখযোগ্য। হংসদূত শিখরিণী ছন্দে ও উদ্ধবসন্দেশ মন্দ্রাকান্তা ছন্দে লেখা। এছাড়া জয়দেবের গান অনুসরণ করে সংস্কৃতে গীতাবলী রচনা করেছিলেন। সংসার ত্যাগ করার পর রূপের নাম হয় রূপগোস্বামী। বিদগ্ধমাধব ও ললিতমাধব নাটকদ্বয় পরিণত রচনা। বৈষ্ণব রসশাস্ত্রের সর্বাধিক প্রামাণ্য দুটি বই ভক্তিরসামৃতসিন্ধু ও উজ্জ্বলনীলমণি তার প্রৌঢ় বয়সের লেখা। রূপগোস্বামী পদ্যাবলী নামে সংস্কৃতে বৈষ্ণব কবিতার একটি সংকলন করেছিলেন।  এখানে সংকলিত কবিতাগুলির লেখক ছিলেন মাধব চক্রবর্তী, জগন্নাথ সেন, জগদানন্দ রায়, সঞ্জয় কবিশেখর প্রভৃতি।

পাঞ্চালী কাব্য :

পুরানো বাংলা সাহিত্য ত্রিধারায় প্রবাহিত। প্রথম গীতিকবিতা, দ্বিতীয় পৌরাণিক গেয়, তৃতীয় অ-পৌরাণিক গেয় কবিতা আখ্যায়িকা। শেষ দুই ধারার রূপ প্রায় এক রকম এবং সে রূপের নাম পাঞ্চালী। দেবতার আখ্যানময় পাঞ্চালী কাব্যের নামে নায়ক দেবতার নামের পরে মঙ্গল কথাটি যুক্ত থাকে তাই এর নাম মঙ্গল কাব্য। মঙ্গল শব্দটির অর্থ গৃহকল্যাণ। অর্থাৎ গোড়ার দিকে এই আখ্যায়িকাগুলো গার্হস্থ্য মঙ্গলকর্ম বা ব্রতের সাথে যুক্ত ছিল। প্রাচীনকবিরাও তাই অনেকে নিজেদের রচনাকে ব্রতগীত বলেছেন। মুকুন্দরামের চন্ডীমঙ্গলের ধনপতি উপাখ্যানে গঙ্গায় তরীবক্ষে শিব-পার্বতির সভায় কালীয় দমনের নাটগীতির যে বর্ণনা আছে তাতে দেবমাহাত্ম নাটগীতের প্রাচীনতম রূপটির আভাস পাওয়া যায়।

মধ্যযুগের ব্রাহ্মণ্যচতনা পুরানো আভিজাত্যের সংকির্ণ আসন থেকে নেমে এসে জনজীবনের বৃহত্তর মিলনভূমিতে সংযোজিত হতে পেরেছিল। কৃত্তিবাসের রামায়ণ গান এই ঐতিহাসিক সত্যেরই ঘোষণা করছে। কৃত্তিবাস ওঝার শ্রীরাম পাঁচালী বা রামায়ণ কাব্য নিয়ে বাংলা সাহিত্যের পাঞ্চালী কাব্য শুরু হয়েছে এরূপ অনুমান অনেকে করেন। কৃত্তিবাসের সময়কাল প্রকৃতভাবে নির্ধারণ হয়নি। তবে তার আত্মবিবরণী থেকে স্পষ্ট বোঝা যায় স্মার্ত ব্রাহ্মণ্য পান্ডিত্যের একশ্রেষ্ঠ প্রতিভূ ছিলেন। পঞ্চদশ শতাব্দীতে আসামে প্রথম রামকথা রচিত হয়েছিলো। এই রামায়ণ কাব্যের রচয়িতা ছিলেন কবি মাধবকন্দোলি। কৃত্তিবাসের নামে যে রচনা আমাদের পরিচিত তা আদ্যান্ত ভক্তিরসে পরিপূর্ণ। সে ভক্তিরস চৈতন্যের ধর্মপ্রভাবিত। মাধবকন্দোলির কাব্যে যে ভক্তিরস তা বিষ্ণুভক্তিনিঃসৃত। বাংলা সাহিত্যের প্রথম গ্রন্থ বলে স্বীকৃত গুণরাজ খানের শ্রীকৃষ্ণবিজয় কাব্যের উল্লেখ পাওয়া যায় কৃষ্ণদাস কবিরাজের চৈতন্যচরিতামৃতে এবং জয়ানন্দের চৈতন্যমঙ্গলে। শ্রীকৃষ্ণবিজয় পাঞ্চালী গেয় কাব্য। এতে অনেক রাগরাগিণীর উল্লেখ আছে। এই কাব্যে গোড়ার দিকে ভাগবত অনুসারে কৃষ্ণলীলা বিবৃত হয়েছে। শেষের দিকে মাঝে মাঝে হরিবংশ অনুসৃত হয়েছে।  গুণরাজের কাহিনী আদ্যান্ত ভাগবতের অনুগামী নয়। খানিকটা তার স্বাধীন রচনা। শ্রীকৃষ্ণবিজয় গাইবার জন্য লেখা হলেও আসলে এটা আখ্যায়িকা পাঞ্চালী (পয়ার প্রবন্ধ)।

নাট্যগীতি পাঞ্চালী ও চন্ডীদাস :

পদাবলীর কবি চন্ডীদাস প্রাচীন বলে সর্বত্র স্বীকৃত। তার উল্লেখ সর্বপ্রথম পাওয়া যায় কৃষ্ণদাস কবিরাজের চৈতন্যচরিতামৃতে ও তারপর জয়ানন্দের চৈতন্যমঙ্গলে। চন্ডীদাসের পদাবলী বিচ্ছিন্ন ও খন্ডিত ভাবে কীর্তন গানের মধ্যে দিয়ে চলে এসেছে এবং বৈষ্ণব-পদাবলীসংগ্রহে গ্রথিত হয়েছে। চন্ডীদাসের বলে প্রচলিত অনেক ভাল ভাল পুরানো গান প্রাচীনতর পুঁথিতে অপর কবির ভণিতা বহন করে। বিভিন্ন জনপ্রবাদের সূত্রে কবির ব্যক্তি পরিচয়টি ধোঁয়াশাচ্ছন্ন রয়ে গেছে। একমতে চন্ডীদাস বীরভূম জেলের নানুরে জাত অন্য মতে চন্ডীদাসকে বাঁকুড়ার ছাতনার লোক বলে ধরা হয়। ১৩১৬ বঙ্গাব্দে বাঁকুড়া জেলার কাঁকিল্যা গ্রামে এক ব্রাহ্মণের বাড়ীতে অযত্নে রক্ষিত একটি কাব্যগ্রন্থ আবিষ্কৃত হয়। এটিই শ্রীকৃষ্ণকীর্তন কাব্য নামে পরিচিত। কবির ভণিতা চন্ডীদাস, বেশীর ভাগ বড়ু চন্ডীদাস। এই গ্রন্থে রাধাকৃষ্ণের লীলা পরম্পরিত পালার আকারে বর্ণনা করা আছে। কিন্তু ভাব, ভাষা, উপস্থাপন পদ্ধতি এমনকি শালীনতা ও রুচীবোধের বিচারে কাব্যটি পুরাপরিচিত চন্ডীদাসের পদাবলী থেকে পৃথক। শ্রীকৃষ্ণকীর্তন কাব্যটি নানা পালা খন্ডে বিভক্ত। জন্মখন্ড, তাম্বুলখন্ড, দানখন্ড, নৌকাখন্ড, ভারখন্ড, ছত্রখন্ড, বৃন্দাবনখন্ড, যমুনাখন্ড, বাণখন্ড, বংশীখন্ড ও বিরহখন্ড। শ্রীকৃষ্ণকীর্তন পুঁথি আধুনিক হোক বা না হোক, তাতে প্রক্ষেপ যেমন এবং যতটাই থাক বা না থাক, তাতে বিশেষ কিছু এসে যায় না। আখ্যান পরিকল্পনায়, চরিত্র-চিত্রণে, ভাবে ও ভাষায় এতে একটি সুগঠিত নাট্য-গীতিকাব্যের সৌষম্য ও সংহতি ঘটেছে। চন্ডীদাস বা বড়ুচন্ডীদাস উপাধির অন্তরালে আত্মগোপন করে শ্রীকৃষ্ণকীর্তন নামে প্রকাশিত এই পাঞ্চালিকা গীতিনাট্যটি যিনি রচনা করেছিলেন তিনি বড় কবি এবং অলঙ্কারশাস্ত্রোক্ত মহাকাব্য-লক্ষ্মণের কোনোটিই এতে না থাকলেও সমসাময়িক বাংলাসাহিত্যের মানদন্ডে এটি একটি উল্লেখ্যযোগ্য মহাকাব্য। এতে মাত্র তিনটি চরিত্র – কৃষ্ণ, রাধা ও বড়ায়ি। তার মধ্যে রাধা চরিত্রের বিকাশে ও পরিণতিতে কবি যে দক্ষতার ও চাতুর্যের পরিচয় দিয়েছেন তা পুরানো বাংলা সাহিত্যে দ্বিতীয় রহিত। শ্রীকৃষ্ণকীর্তনের বেশীরভাগ ছন্দ পয়ার আয় – এই পয়ারের ধ্বনিপ্রবাহ ছাড়া ছাড়া। ত্রিপদী সূষম নয়। ছন্দে নতুনত্ব নেই। তবে নতুনত্ব আছে পয়ারের চার ছত্র নিয়ে ‘চউপঈ” জাতীয় স্তবক গঠনে। এ রীতি সম্ভবত সংস্কৃতের অনুকরণে। বড়ু চন্ডীদাস ছাড়াও চৈতন্যপূর্ব যুগে আর অনেকগুলি চন্ডীদাসের খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে। দ্বিতীয় জন পদকর্তা চন্ডীদাস যিনি চৈতন্যচরতামৃত – ধৃত মহাপ্রভূর আস্বাদিত পদটি রচনা করেছিলেন। চৈতন্যোত্তর দুজন চন্ডীদাসের মধ্যে দীন চন্ডীদাস অপেক্ষাকৃত নীরস ও সাহিত্যগুণে দুর্বল পদাবলীর রচয়িতা হলেও পুঁথিগত প্রমাণসিদ্ধ কবি। অন্যপক্ষে দ্বিজ চন্ডীদাসের অস্তিত্ব কিংবদন্তি, পরোক্ষ প্রমাণ এবং অনুমানের উপর নির্ভরশীল। এই চারজন ছাড়াও সহজিয়া ভাবের সাধক একাধিক চন্ডীদাস কবি ছিলেন তাতে কোনো সন্দেহ নেই। এঁদের মধ্যে তরুণী রমনের চন্ডীদাস, কলঙ্ক-ভঞ্জের চন্ডীদাস তো আছেনই তাছাড়াও একই নামের আরো অনেক কবি হয়ত সহজিয়া গানগুলোর মধ্যে আত্মগোপন করে আছেন।

বিদ্যাপতি :

মিথিলার শৈব রাজা শিবসিংহের সভাকবি ও সভাপন্ডিত বিদ্যাপতিও ছিলেন শৈব। তার প্রতিভা ছিল বিচিত্রচারী। একাধারে তিনি স্মার্ত পন্ডিত, ঐতিহাসিক, ভৌগোলিক এবং কবি ছিলেন। কিন্তু বাংলা সাহিত্যে তিনি কেবলমাত্র বৈষ্ণব-কবি চুড়ামণি রূপেই খ্যাত। বিদ্যাপতি পদাবলীর অতুল্য গৌরব বাংলা বৈষ্ণবসাহিত্যের ইতিহাসে ভাব-ভাষাগত এক নতুন রস-মান সৃষ্টি করেছিল। চৈতন্যোত্তর যুগের কবিশ্রেষ্ঠ গোবিন্দদাস কবিরাজ একই ধারা অনুসরণ করে দ্বিতীয় বিদ্যাপতি আখ্যায় ভূষিত হয়েছিলেন। বিদ্যাপতির প্রতিভা ছিল সর্বতোমুখী। তার বিভাসাগর, দানকাব্যাবলী পান্ডিত্য -বিচার সম্বলিত স্মৃতিগ্রন্থ, বর্ষক্রিয়া, গঙ্গাবাক্যাবলী, দুর্গাভক্তিতরঙ্গিণী, ব্যাড়িভক্তিতরঙ্গিণী পৌরাণিক হিন্দুর পূজা ও সাধন পদ্ধতির সঞ্চয়ন, কীর্তিলতা, কীর্তিপতাকা উৎকৃষ্ট ইতিহাস গ্রন্থ, ভূপরিক্রমা ভৌগোলিক তীর্থপরিক্রমা, পুরুষপরীক্ষা মনীষা ও শিল্পকৃতির সমন্বয়রূপ কথাসাহিত্য, লিখনাবলী অলংকারশাস্ত্রবিষয়ক গ্রন্থ।,ভাষা সৃষ্টির ক্ষেত্রেও তিনি ছিলেন বিচিত্রকর্মা, মাতৃভাষা মৈথিলি ছাড়াও আরো তিনটি ভাষায় তিনি গ্রন্থ রচনা করেছিলেন বলে মনে করা হয়। মাতৃভাষা মৈথিলিতে লেখা বিদ্যাপতির হরগৌরি বিষয়ক পদাবলী ছাড়াও কিছু সংখ্যক রাধাকৃষ্ণ পদাবলীও পাওয়া গেছে। স্মৃতি ও ধর্মশাস্ত্র বিষয়ক এবং পুরুষ পরীক্ষা সংস্কৃত ভাষায় লেখা, কীর্তিলতা ও কীর্তিপতাকা অবহট্‌ঠ ভাষায় লেখা। কিন্তু বাংলাদেশে প্রচলিত রাধাকৃষ্ণের প্রেম বিষয়ক বিদ্যাপতির পদাবলীর ভাষাই সর্বাপেক্ষা কৌতূহলজনক। বাংলাদেশে বিদ্যাপতির অনুরূপ পদ যত পাওয়া গেছে তার সবকটি বাংলা-অবহট্‌ঠ-মৈথিলি এক কৃত্রিম ভাষায় রচিত। পরবর্তী কালে এই ভাষাকে ব্রজবুলি নামে অভিহিত করা হয়েছে। ব্রজবুলি ব্রজের ভাষা নয়। এই কৃত্রিম কাব্য ভাষার কাব্যভাষার মাধ্যমে রাধাকৃষ্ণের ব্রজলীলা উৎকৃষ্ট গীতিরূপ লাভ করেছে, তাই ব্রজবুলি। বিদ্যাপতি সকল ক্ষেত্রেই মিষ্ট বচন অর্থাৎ ভাবের শ্রুতিমধুর উপস্থাপনার পক্ষপাতী ছিলেন। আলংকারিক পরিভাষানুযায়ী রাধাকৃষ্ণের প্রেমলীলা চিত্রণে বিদ্যাপতি সম্ভোগাখ্য শৃঙ্গার রসের কবি। আর সে রসের বর্ণনায় তিনি জয়দেব গোস্বামীর অনুসরণ করেছিলেন। গভীর হৃদয়াবেগ ও করুণ প্রেমার্তির তুলনায় উজ্জ্বল-রসাশ্রিত প্রণয়-উচ্ছলতার প্রতি তার আকর্ষণ ছিল বেশী। জয়দেব যেমন দেবভাষায় লোককথাকে আভিজাত্য দান করেছিলেন তেমনি অভিজাতগোষ্ঠীর মধ্যে সেই একই লোকগাথাকে লোকায়ত ভাষায় প্রথম প্রকাশ করলেন বিদ্যাপতি। দুই কবির রচনা এক হলেও তাদের কবি মানসের গঠন ছিল অনেকটাই অভিন্ন। বিদ্যাপতির রাধাকৃষ্ণ পদাবলী যত না অনুভূতি ঘন; তার চেয়ে বেশী অলঙ্কার সমৃদ্ধ, সংস্কৃত সাহিত্য প্রভাবিত উজ্জ্বলতায় বর্ণাঢ্য।

অ-পৌরাণিক সাহিত্য ও মঙ্গলকাব্য :

অ-পৌরাণিক বলতে যা প্রাচীনতর অর্থাৎ খ্রীষ্টিয় দশম শতাব্দীর পূর্ববর্তী সংস্কৃত পুরাণে অপ্রাপ্ত। পরবর্তীকালে রচিত সংস্কৃত পুরাণে আছে তবে বিশদে পাওয়া যায় অথবা শুধুই পাওয়া যায় বাংলাসাহিত্যে পঞ্চম থেকে অষ্টম শতাব্দীর মধ্যে। অর্বাচীন পুরাণে ও নব্য ভারতীয় ভাষায় লৌকিক পাওয়া গেলেও এসব দেবভাবনার বীজ ঋগবেদে মেলে। এমনকি কোনো কোনো দেবতা ও কাহিনীর বীজ আরো আগে পাওয়া যায়। এইসব নবদেবতাকে নিয়ে বাংলার জনগণমধ্যে যেসব লোকগাথার ব্যাপক প্রচলন হয়েছিল সেগুলি মঙ্গলকাব্য নামে পরিচিত। মনে করা যেতে পারে একেবারে সুপ্রাচীনকাল থেকেই বাংলার লোক-সাধারণ তাদের নিজস্ব আদর্শ অনুসারে নিজ নিজ লৌকিক দেবতাদের পূজা পদ্ধতি ও মহিমাজ্ঞাপক কাহিনী রচনা করেছিল। বলাবাহুল্য তার ভাব ও ভাষা -– দুই-ই কালের সাথে পরিবর্তিত হয়েছে। বাংলাভাষা সাহিত্যের আদিযুগে অ-সম্পূর্ণ ভাষায় অ-গঠিত কাব্যে ঐ সকল দেবদেবীর মহিমাগাথা পাঁচালীর আকারে রচিত হয়েছিলো। পরে ত্রয়োদশ শতাব্দীর যুগপ্লাবি প্রয়োজনের প্রভাবে এই পাঞ্চালীকাব্য ধীরে ধীরে পরিণততর মঙ্গলকাব্যের আকার ধারণ করেছে।

তুর্কি আক্রমণের পূর্বে সেনরাজাদের আমলে বাংলাদেশের ব্রাহ্মণ্যধর্ম-সংস্কারের  সার্থক অভ্যুত্থান ও বহুল বিস্তার ঘটেছিল।  রাজশক্তির পৃষ্ঠপোষকতায় ব্রাহ্মণ্যধর্ম আভিজাত্যরূপ ধারণ করেছিল। তুর্কি আক্রমণোত্তর যুগে তা ত্রিশংকু অবস্থা সঙ্কট হয়। ফলে ব্রাহ্মণ্য ধর্মের কর্ণধারগণ লোকজীবনের সাধারণ সংস্কার, তাদের ধর্মবিশ্বাস এমনকি তাদের দেবদেবীকে গ্রহণ করে আর্য আভিজাত্য দান করেন। আর্যীভবনের এই সুযোগে যে সকল লৌকিক দেবতা এই সময় রুপান্তরিত হয়েছিলেন তাদের মধ্যে মনসা, চন্ডী ও ধর্মঠাকুর উল্লেখযোগ্য এবং এইসব লৌকিক দেবতা নিয়ে রচিত মনসামঙ্গল, চন্ডীমঙ্গল, ধর্মমঙ্গল উল্লেখযোগ্য।

একেবারে প্রাথমিক অংশে মঙ্গলকাব্য কাঠামোর রূপরচনায় প্রাচীন সংস্কৃত পুরাণের আদর্শ সচেতন ভাবে অনুসরণ করা হয়েছিল। মঙ্গলকাব্যের প্রারম্ভে বন্দনাংশে পুরাণের বহুদেবতা বন্দনার আদর্শকেই অনুসরণ করা হয়েছে। ঐ অংশে বিভিন্ন দেবতার মাহাত্ম প্রকাশ উপলক্ষে পৌরাণিক শ্লোকের ভাব এমনকি ভাষাগত ঐতিহ্যকেও অনুসরণ করা হয়েছে। মঙ্গলকাব্যের সৃষ্টিতত্ত্বও অনেকাংশে পৌরাণিক সৃষ্টিতত্ত্বের আদর্শানুগ। অ-পৌরাণিক দেবকথার দেহে পৌরাণিক ঐতিহ্যকে অঙ্গীকৃত করে নেবার সচেতন প্রয়াসটুকু স্পষ্ট হয়ে রয়েছে গোটা দেবখন্ড জুড়ে। মঙ্গলকাব্যের মনুষ্যখন্ড পুরাণেতর স্বকিয়তার দাবী করতে পারে।

প্রায় প্রত্যেকটা মঙ্গলকাব্যের সূচনা বন্দনা দিয়ে। বন্দনা অংশে শুধু যে কোনো বিশেষ দেবতার বন্দনা করা হত তাই নয়, বর্ণিতব্য মঙ্গল দেবতার পক্ষ-বিপক্ষ সকল দেবদেবীর বন্দনা করা হতো। যেমন মনসামঙ্গল কাব্যে চন্ডী ও মনসার দ্বন্দ্ব একান্ত তীব্রভাবে প্রদর্শিত, সেখানেও প্রারম্ভিক অংশে চন্ডী আদ্যাশক্তি রূপে বন্দিত হয়েছেন।

মঙ্গলকাব্য মাত্রেরই দ্বিতীয়াংশে সাধারণত গ্রন্থোৎপত্তির কারণ বর্ণিত হয়েছে। এই প্রসঙ্গে কবির ব্যক্তি পরিচয়ও উল্লেখ করা হয়েছে। এই অংশ কবির আত্মপরিচয় নামে অভিহিত হয়ে থাকে। এখানেও পুরাণের আদর্শেই মঙ্গলকাব্যের অপৌরুষেয়তা প্রতিপাদনের চেষ্টা করা হয়েছে। অনুমান করা যেতে পারে প্রাথমিক পর্যায়ে ঐসব দৈবাদেশের কাহিনী লোকসাধারণের শ্রদ্ধা আকর্ষণ করার কৌশল হিসাবে ব্যবহৃত হয়েছিলো।

মঙ্গলকাব্যের তৃতীয়াংশ সাধারণত দেবখন্ড নামে পরিচিত। এই অংশে লোকজীবনাশ্রিত মূল কাব্যকথাকে পুরাণের রূপাধারে অভিজাত আকার দেবার চেষ্টা করা হয়েছে। মঙ্গল দেবতারা অনার্য পরিকল্পনা থেকে সৃষ্ট, বস্তুত তাদের চারপাশে আর্য ঐতিহ্যের বিভূতি গড়ে তোলার আকাঙ্খা থেকেই এই অংশের জন্ম। ফলে পুরাণের অভিমত করে সৃষ্টিতত্ত্বের ব্যাখ্যা, নানা দেবদেবীর মাহাত্ম্য বর্ণনা প্রমুখ উপায়ের আশ্রয় গ্রহণ করা হয়েছিল। আলোচ্য দেবখন্ডে মোটামুটি যেসব বিষয়ের অবতারণা করা হতো তাতে রয়েছে সৃষ্টি রহস্য কথন, দক্ষ প্রজাপতির শিবহীন যজ্ঞ, সতীর দেহত্যাগ, হিমালয় গৃহে তার নবজন্ম লাভ, মদনভস্ম, উমার তপস্যা ও তার বিবাহ, কৈলাসে হর-গৌরীর কোন্দল, শিবের ভিক্ষাযাত্রা ইত্যাদি। এখানে উল্লেখ্য যে দেবখন্ডের সাধারণ বিষয় সূচি উদ্ধার করা হয়েছে। ধর্মমঙ্গলকাব্যের দেবখন্ডে অনুকরণ নেই।  অন্যান্য মঙ্গলকাব্যেরও নানা অংশে ছোট বড়ো পার্থক্য রয়েছে অল্পবিস্তর।

চতুর্থ সংখ্যক নরখন্ডই মঙ্গলকাব্যের সর্বপ্রধান খন্ড। এই অংশে কোনো দেবশাপগ্রস্ত দম্পতির মর্ত্যজীবনের বর্ণনা করা হয়ে থাকে। মূলত আলোচ্য মঙ্গল দেবতার পূজা প্রচারের জন্য তারা ঐ বিশেষ দেবতার দ্বারা পৃথিবীতে প্রেরিত হয়ে থাকেন। এখানে এসে মনুষ্য জীবনের দুঃখকষ্ট ভোগ, কৃচ্ছসাধনার ফলে দেবদেবীর পূজা প্রচারে সমর্থ হন। এই অংশে মনুষ্যজীবনের বর্ণনা উপলক্ষে বারমাস্যা, নায়কের রূপ দর্শনে নারীগণের পতিনিন্দা, কাঁচুলি নির্মাণ, নায়িকার রন্ধন প্রণালী, চৌতিশা ইত্যাদি বহু প্রসঙ্গের ব্যবহারের ফলে নরখন্ডের অপরিহার্য উপাদানে পরিণত হয়েছিল।

পরবর্তী কোনো সময়ে মনসামঙ্গল, চন্ডীমঙ্গল ও ধর্মমঙ্গল কাব্য নিয়ে একটু বিস্তারে আলোচনার ইচ্ছা রইলো।

ঋণ স্বীকার :
বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস (প্রথম খন্ড) – ডঃ সুকুমার সেন।
বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস (প্রথম পর্যায়) – ভূদেব চৌধুরী।
বাংলা সাহিত্যের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস – ভূদেব চৌধুরী।
লেখক পরিচিতি
শৈবাল বসু

নরেন্দ্রপুর রামকৃষ্ণ মিশন থেকে মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক পাশ করার পর সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজ থেকে পদার্থ বিদ্যা নিয়ে স্নাতক। পেশাগত ভাবে গত ৩৪ বছর ধরে ব্যাঙ্কার। নেশাগত ভাবে শরদিন্দু ও ইতিহাস প্রেমী। বর্তমানে কলকাতা ও বাংলার ইতিহাস নিয়ে চর্চারত।

Author

Du-কলম

Join the Conversation

  1. বাংলা ভাষা যে কতো সমৃদ্ধ, তা নতুন করে বলবার অপেক্ষা রাখে না। কিন্তু অধিকাংশেরই মতে রবীন্দ্রনাথই বাংলা ভাষার প্রথম ও শেষ কথা। কিন্তু তাঁর পূর্বেও যে কতো যশশ্বী কবি (তৎকালীন যুগের লেখকও বটে) বাংলা ভাষাকে মাধুর্যের শিখরে নিয়ে গেছিলেন, তা অনেকেরই অজানা। নিজেদের ইতিহাসকে জানা এবং মনে রাখা যে কোনোও জাতিরই অহংকার। বাঙালী আত্মবিস্মৃত জাত, তাই বিদেশী সাহিত্যের মণিমুক্তোর চাকচিক্যে মোহিত হয়ে নিজেদের অমূল্য হীরকরাজিকে ভুলে গেছে – এটা খুব দুঃখের।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!